১০ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
সর্বশেষ
১০ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
সর্বশেষ

পানিবন্দি ৩০ গ্রাম, অসহায় গ্রামবাসী

নিজের একচিলতে জমি আবাদ করে এবং অন্যের জমিতে মজুরি খেটে বেশ সুখেই দিন কাটছিল ৭০ বছর বয়সী হাসান আলীর। কিন্তু কয়েক বছর আগে মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতা কেড়ে নিয়েছে তার সেই সুখ। জলাবদ্ধতার কারণে শুধু নিজের জমি নয়, অন্যের জমিতেও জুটছে না কাজ। আশপাশের কয়েক গ্রামের ফসলি জমিতে আবাদ হয় না এখন কোনো। তিন বছর আগে তার স্ত্রী গত হয়েছেন। নতুন করে ঘর বেঁধেছিলেন। কিন্তু অভাবী সংসারে চাহিদা অনুযায়ী খরচ জোগাতে না পেরে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তিনিও। এখন ডোবানালায় মাছ ধরে জীবন কাটাচ্ছেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার আলীপুর গ্রামের হাসান আলী।

ছেলেসন্তানরা আলাদা থাকে, তাদের কাছেই তাকে থাকতে বলে তারা। কিন্তু খেটে খাওয়ার মতো এখনও শক্তি রয়েছে গতরে। তাই আলাদাই থাকেন। একটানা কথাগুলো বলে একটু থামলেন ৭০ বছরে পা দেওয়া হাসান আলী। হাসান আলীর মতো গোয়ালফা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী আব্দুস সামাদের সংসারের সুখও কেড়ে নিয়েছে এলাকায় মনুষ্যসৃষ্ট কয়েক বছরের জলাবদ্ধতা। মাত্র ১০ কাঠা জমিতে আবাদ করে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিল। কিন্তু এলাকার নিজেদের জমিসহ সরকারি খাল ও জলা দখল করে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করার পর সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। আব্দুস সামাদ বলেন, ‘স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে আমার ওই একচিলতে জমিতে সাত বছর ধরে আর কোনো ফসলাদি হয় না। অথচ ওই জমি থেকে উৎপাদিত ফসলে আমার ছয় মাসের খাবার জুটেছে। এখন  দিনমজুরিও জুটছে না। ভ্যান, রিকশা ও সাইকেল মেরামত করে দিন কাটাচ্ছি।’

ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় এক যুগ আগে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়ারী বিলের জমি এক ফসলি হওয়ার অজুহাতে জমির মালিকরা পুকুর খনন শুরু করেন। তাতে মাছ চাষ করে লাভবান হতে দেখে উৎসাহিত হন আশপাশের গ্রামের মানুষ। তাদের দেখাদেখি পাশের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা, বিয়াঘাট ও নাজিরপুর ইউনিয়নের মহারাজপুর, বৃ-পাথুরিয়া, বি-চাপিলা, নওয়াপাড়া, পুরুলিয়া, ধানুরা, পাইকপাড়া, কমপাথুরিয়া, পাইকপাড়া, রওশনপুর, গজেন্দ্রচাপিলা, কান্দাইল, বাকিবেগপুর, রানীনগর, গোপীনাথপুর, খামার পাথুরিয়া, আলিপুরসহ অন্তত ২০ গ্রামের ফসলি জমি কেটে পুকুর খননের মহোৎসব শুরু হয়। একই সঙ্গে বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়ারী, নওদা, তিরাইল, উপলশহর, লক্ষ্মীপুর, পাবনাপাড়া, পকল্লাপাড়া, বগুড়াপাড়া, গোয়ালফাসহ আরও দশ গ্রামেও ফসলি জমিতে পুকুর খননের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া পানি নিস্কাশন মীর্জা মোহম্মদ বেগ খাল ও তুলশী গঙ্গা খাল দখল করে পুকুর খনন করেন। বর্ষা মৌসুমে এ দুটি খাল দিয়ে কয়েকটি গ্রামের ফসলি মাঠের পানি গিয়ে বড়াল নদীতে পড়ত। কিন্তু ওই খাল দুটি দখল করাসহ যত্রতত্র ও অপরিকল্পিতভাবে শত শত পুকুর খনন করায় অন্তত ৩০ গ্রামের পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর ধরে। ফলে ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে অনাবাদি পড়ে রয়েছে প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমি।

গুরুদাসপুরের আলিপুর গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বড়াইগ্রামের জোয়ারী গ্রামের পাশে আমার প্রায় ছয় বিঘা তিন ফসলি জমি ছিল। ওই সব জমির আশপাশে পুকুর খনন করায় ছয় বছর ধরে ফসল আবাদ করতে পারছি না।’ কামাল হোসেন নামে অন্য এক কৃষক বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কারণে আশপাশের অন্তত ১৫-২০টি গ্রামের ধানিসহ তিন ফসলি এবং আম, কাঁঠাল ও বিভিন্ন ফলের বাগানে এখন কোনো ফসল আবাদ করা যায় না। এসব এলাকার ধনাঢ্য কৃষকদের অনেকেই এখন ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন। প্রভাবশালী পুকুর মালিকের অধীনে দিনমজুরি করে জীবন কাটাচ্ছেন তারা এখন।’

বড়াইগ্রামের নওদা গ্রামের গৃহবধূ আসমা বেগম বলেন, ‘আগে তাদের বাড়িতে কোনোদিন পানি জমে থাকেনি। এখন কয়েক বছর ধরে পানি-কাদার মধ্যে বাস করতে হচ্ছে।’ গোয়ালফা গ্রামের রহিমা বেগম বলেন, ‘তিন ফসলি জমিতে এখন কোনো ধান আবাদ হয় না আমাদের। জলাবদ্ধতার কারণে এখন বাঁশের সাঁকো বানিয়ে পাকা সড়ক থেকে বাড়িতে ঢুকতে হচ্ছে।’

আলিপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত আবুল কাশেমের পুত্রবধূ পারুল বেগম বলেন, ‘জমির ধানে আগে বছর চলে যেত। বেকার হয়েছেন স্বামী, শ্বশুর ও দেবর। আর কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না। তাই এবার পানিতে ডুবে থাকা জমির চারদিকে মাটি ফেলে উঁচু করে পুকুর করেছি।’

গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন ভুট্টো বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের কারণে আমার ইউনিয়নসহ চারটি ইউনিয়নের ৩০ গ্রামের প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। চাষাবাদ করতে না পেরে অনেকেই বাড়ি ও জমি ফেলে রেখে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অনেকে জমি থেকেও ভূমিহীন হয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনওর মাধ্যমে সভা করে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যত্রতত্র পুকুর খননের কারণে বেশ কিছু জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে কয়েক বছর ধরে। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের নজরে রয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে।’

অন্যদিকে বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ভূমিদস্যুদের কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এসব ভূমিদস্যু রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে পানি নিস্কাশনের সরকারি খালবিলসহ মানুষের জমি দখল করে অবৈধভাবে যততত্র পুকুর খনন করেছে। এসব কারণে কয়েক হাজার হেক্টর জমি এখন অনাবাদি। এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খাল, বিল, জলা পুনরুজ্জীবিত করলে এই সমস্যা থাকবে না। সামান্য বরাদ্দ দিয়ে কিছু মানুষের সামান্য উপকার হতে পারে, কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য দখল উচ্ছেদ করাসহ সংশ্নিষ্ট সব বিভাগের সমন্বিত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তমাল হোসেন বলেন, ‘সহকারী কমিশনার ভূমি ও কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্ট বিভাগ এই জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে জরিপ শুরু করেছে।’

অন্যদিকে বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘বিষয়টি সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুকুর খনন করায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে উপজেলা কৃষি অফিস আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি খতিয়ে দেখে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার এই জলাবদ্ধতার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন নির্মাণসহ সমস্যা সমাধানের জন্য এরই মধ্যে ওই দুই উপজেলা কৃষি কর্মকতা ও সেচ কমিটির মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘বিরোধিতা করা সত্ত্বেও অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করা হয়েছে। তাদের ক্ষমতা বেশি হওয়ায় ব্যর্থ হয়েছি। মানবসৃষ্ট এই জলাবদ্ধতা নিরসনে এরই মধ্যে সংশ্নিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বয়ে একটি জরিপ টিম কাজ শুরু করেছে। ওই টিমের প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে

Comments

Facebook
Twitter
Pinterest
Reddit
Skype
Email
LinkedIn

নিউজ আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০