রাজশাহী মহানগরী থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের কোল ঘেঁষে বানেশ্বর ও ঝলমলিয়া কলার হাট এ অঞ্চলে বিখ্যাত। যেখানে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় কয়েক কোটি টাকার কলা। এ কলা চলে যায় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। শনি ও মঙ্গলবার বানেশ্বর, সোম ও বৃহস্পতিবার বসে ঝলমলিয়া হাট। এসব হাট থেকে কলা কিনে ব্যবসায়ীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠান। শুধু বানেশ্বরেই প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ হাজার কাঁদি কলা আমদানি হয়। সে হিসাবে দেখা যায়, গড়ে ৪০০ টাকা কাঁদি ধরলেও বানেশ্বর হাটেই এক কোটি টাকার কলার বেচাকেনা হয়। শীতকালে কম আমদানি হলেও গরমকালে কলার আমদানি বেশি হয়। প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক কলা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
বছরের পর বছর ধরে রাজশাহীর সহজলভ্য ও জনপ্রিয় ফল কলার বড় যোগান দিয়ে যাচ্ছেন রাজশাহীর চাষিরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তাদের কলা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতেই বছরে ৫০০ কোটি টাকার কলার বাজার গড়ে উঠেছে এই জনপদে। রাস্তা ও পুকুরপাড়ে কলার আবাদ, নতুন জাতের উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল কলার চাষ এবং মানুষের খাদ্য তালিকায় কলার অন্তর্ভুক্তিতে রাজশাহী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে কলার আবাদ ও উৎপাদন। কৃষকরা জানান, জমি ছাড়াও পুকুর পাড়েই বেশি কলার আবাদ হচ্ছে। নতুন তোলা মাটিতে ফলন হয় সবচেয়ে বেশি। তাই নতুন কাটা পুকুরপাড়কেই চাষিরা কলাচাষের জন্য বেশি বেছে নেন।
জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহী জেলায় ২০১৭-১৮ মৌসুমে এক হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে কলার উৎপাদন হয়েছিল ৬১ হাজার ৭৫৬ মেট্রিকটন। এ সময় হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ৩০.৬০ মেট্রিকটন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ২৫ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়ে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৪৯১ মেট্রিকটন। পরের বছর (২০১৯-২০) আবাদ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৯৬২ হেক্টরে। ওই সময় ফলনও কম হয়। মোট উৎপাদন হয় ৬২ হাজার ৪০৪ মেট্রিকটন। তবে ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন আবারও বাড়ে। এ বছর ১ হাজার ৯৭৩ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৬৪ হাজার ৬৩ মেট্রিকটন কলা। আগের চেয়ে হেক্টরপ্রতি গড়ফলন বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৪৭ মেট্রিকটন। গত মৌসুমে (২০২১-২২) আকস্মিকভাবে বাড়ে কলার আবাদ ও উৎপাদন। এক বছরের ব্যবধানে রাজশাহী জেলায় ৪৩৭ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ বৃদ্ধি পায়। আবাদি জমির ওপর ভিত্তি করে এক বছরের ব্যবধানে মোট উৎপাদন হয় ৭৮ হাজার ৭৮০ মেট্রিকটন, যা গত বছরের চেয়ে ১৪ হাজার ৭১৭ মেট্রিকটন বেশি। গড়ফলনও বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৮৯ মেট্রিকটন। চলতি মৌসুমে জেলায় কলা চাষ হচ্ছে ২৪৩০ হেক্টর জমিতে। এতে সাম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৬৫৩ মেট্রিকটন।
রাজশাহীর পবা উপজেলার কালিচিকা গ্রামের খায়রুল ইসলাম প্রায় একযুগ ধরে কলা বাগান করেছেন। নিজের পাঁচ বিঘা জমিতে কলার চাষ করেছেন তিনি। এ ছাড়া আরও জমি লিজ নিয়ে ১০ হাজার গাছ রোপণ করেছেন। এক বছরের জন্য তিনি ১৫ লাখ টাকায় এ জমি লিজ নিয়েছেন। খায়রুল জানান, তিনি প্রতি সপ্তাহে ৫০০ কাঁদি কলা রাজশাহীর বানেশ্বর কলার হাটে বিক্রি করেন। গরমের সময় কলার কাঁদিপ্রতি দাম পেয়েছেন ৬০০ টাকা পর্যন্ত। শীতকালে দাম কিছুটা কম। তিনি বলেন, খরচ বাদ দিয়ে তার প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাভ হয়।
পবার দাউদপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাক এলাকার ২৬টি পুকুরপাড় লিজ নিয়ে সাত হাজার কলাগাছ রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, কাঁদি দেখে গাছপ্রতি ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা দাম পাওয়া যায়। গত বছর ১৩ লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছি। এবার আশা করি ভালোই লাভ হবে।
ঢাকার কলার পাইকারি ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক জানান, প্রতি হাটে গড়ে দুই হাজার কাঁদি কলা কেনেন তিনি। এরপর তা ঢাকার বিভিন্ন মোকামে পাঠান। সপ্তাহে তিন ট্রাক কলা ঢাকায় পাঠান তিনি। কলার আড়তদার শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রতি হাটে ১০ থেকে ২০ হাজার কাঁদি কলা ওঠে। ঢাকা, সাভার, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কলা পাঠান তারা। শীতকালে ভালো কলা ২০০ থেকে ৬০০ টাকা কাঁদি এবং গরমকালে ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কাঁদি বিক্রি হয়।
রাজশাহী কৃষি দফতরের তথ্যমতে, পাঁচ বছর আগে যেখানে এক হাজার ৯০২ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হত, সেখানে বর্তমানে চাষ হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে। আবার পাঁচ বছরের ব্যবধানে কলার উৎপাদনও বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানিয়েছে, রাজশাহীর ৯ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ হয় পুঠিয়া উপজেলায়। এ উপজেলায় মোট এক হাজার দুই হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। এ উপজেলাতেই বসে রাজশাহীর সবচেয়ে বৃহৎ, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কলার হাট। কলার আবাদ ও উৎপাদনে পুঠিয়ার পর দূর্গাপুরের অবস্থান। এখানে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। এছাড়া বাগমারা, পবা, চারঘাট ও বাঘায় প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। তবে জেলার তানোর, মোহনপুর, গোদাগাড়ী ও চারঘাটে কলার আবাদ নেই বললেই চলে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, কলাচাষ এখন খুবই লাভজনক। কলার ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। প্রতি বিঘা জমিতে কলাচাষ করতে খরচ হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। লাভ হচ্ছে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সবরি বা অনুপাম বা মানিক কলার। সাগর কলার চাষও হয়, তবে তা পরিমাণে কম। ঢাকাসহ সারাদেশেই রাজশাহীর কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।